বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘কাজীর ভাত’!

ইমতিয়াজ আহমেদ :
কাজীর ভাত! গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে ভিন্ন স্বাদের মজার এই খাবারটি। এক সময়ে গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরেই একটি নির্দিষ্ট সময় ‘ঘটা’ করে আয়োজন করা হতো ‘কাজীর ভাত’। এই কাজীর ভাত রান্না উপলক্ষ্যে আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলা হতো। কাজীর ভাত রান্নাকে ঘিরে সকালটা থাকতো উৎসব মুখোর। তবে শহুরে সংস্কৃতির প্রভাবে দিন দিন গ্রামের এই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, কাজীর ভাত সাধারণত বছরের চৈত্র মাসে গ্রামের প্রায় ঘরেই রান্না করা হয়। এছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ে রান্না করা হলেও গরমের মৌসুমে এই ভাতের আয়োজনটা বেশি হয়ে থাকে। কাজীর ভাতের প্রধান এবং অন্যতম আকর্ষণ হলো নানা রকম ভর্তার সমাহার এবং ইলিশ, পুটি মাছ, চাপিলা বা বাটা মাছ কড়া করে ভাজা। দেখতে সাধারণ ভাতের মতো হলেও কাজীর ভাত এক বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। এর স্বাদ ও গন্ধও আলাদা। এই ভাত রান্না করতে হলে চাল কমপক্ষে সাত দিন মাটির হাঁড়িতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। সাত দিনের একদিন আগে রান্না করলেও এর প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে না। অনেকে আট/নয় দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখেও এই ভাত রান্না করে থাকে। সেক্ষেত্রে গন্ধ বেশ তীব্র হয়।
স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, অতীতে মাটির হাঁড়িতে চাল ভিজিয়ে রাখার রেওয়াজ থাকলেও বর্তমানে যেকোনো পাত্রেই চাল ভিজিয়ে রাখা যায়। রান্নার সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখা চাল ভালো করে ধুয়ে সাধারণ রান্নার মতোই ভাত রান্না করা হয়। ভাত হয়ে এলে টক গন্ধ বের হয়। অনেকে আবার ভূনা খেচুরির আদলেও রান্না করে থাকে। তবে সাদা ভাতের মতোই বেশির ভাগ রান্না হয়ে থাকে। ভাত রান্না শেষে আয়োজন করা হয় নানান পদের ভর্তা। মূলত এই ভর্তাই কাজীর ভাতের প্রধান আকর্ষণ।
গৃহবধু আরিশা জান্নাত বলেন,’ভর্তা যত বেশি হবে কাজীর ভাতের স্বাদ তত বাড়বে। ভর্তার মধ্যে রয়েছে কালোজিরা ভর্তা, কাঁচামরিচের সাথে রসুন ভর্তা, বাদাম ভর্তা, ধনিয়া পাতা দেশী ও বিলেতী, কুমড়ার খোসা,পটলের খোসা, বেগুন, কচু, চিংড়ি মাছ, ইলিশ মাছের মাথা, ছোট মাছের শুঁটকি ও টাকি মাছ ভর্তা কাজীর ভাতে থাকতেই হবে। ভর্তার সাথে ইলিশ, পুঁটি, চাপিলা মাছ ভাজা দিয়েও পরিবেশন করা হয় কাজীর ভাত।’
তানজিল চৌধুরী নামের এক তরুণ ব্যবসায়ী বলেন,’ছোট সময়ে যখন গ্রামের বাড়িতে থাকতাম,তখন মাঝে মধ্যেই কাজীর ভাত রান্না করা হতো। বাড়িতে রান্না করা কাজীর ভাতের গন্ধ এখনো নাকে লেগে আছে। ঢাকা শহরে দীর্ঘদিন ধরে আছি। এখানে খুব একটা খাওয়া হয় না। এখনকার গৃহবধুরা কাজীর ভাতকে গুরুত্ব দেয় না। অনেকে রান্নাই জানে না। দুই/এক বছর পর পর সুযোগ হয় কাজীর ভাত খাবার।’
কাজীর ভাত সাধারণত বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের একটি বিশেষ খাবার। বর্তমানে খুব বেশি প্রচলিত না হলেও গ্রামে বসবাসরত পরিবারগুলোতে বছরে দুই/একবার কাজীর ভাত রান্না হয়। মাদারীপুর, ফরিদপুর,শরিয়তপুর এবং ক্ষেত্র বিশেষে বরিশালের বিভিন্ন এলাকাতেও কাজীর ভাত রান্না করা হয়ে থাকে। কাজীর ভাতে টক স্বাদ ও টক গন্ধ বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে অপছন্দের হলেও বয়স্কদের কাছে ভীষণ প্রিয় কাজীর ভাত। বর্তমান সময়ে গ্রামীণ সমাজে শহুরে জীবনযাত্রার প্রবেশের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য গ্রামীণ ঐতিহ্য। কাজীর ভাত হারিয়ে যেতে বসা গ্রামীণ ঐতিহ্য খাবারেরই একটি অংশ।