মাদারীপুরে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও আয়া পদে চাকরি না পাওয়ার অভিযোগ

সুবল বিশ্বাস :
মাদারীপুরে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও আয়া পদে চাকরি না পেয়ে অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন লাবলী আক্তার। বেশি টাকা ঘুষ পেয়ে মর্জিনা নামে অন্য এক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে সদর উপজেলার শেখ শহিদুল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ লুৎফর রহমান হাওলাদারের বিরুদ্ধে। শনিবার (২৪জুন) ওই বিদ্যালয়ে আয়াসহ বেশ কয়েকটি পদে নিয়োগ পরীক্ষা হয়। পরিবারের অভিযোগ প্রায় ৪ বছর ওই স্কুলে বিনা বেতনে আয়া পদে কর্মরত থাকা লাবলীকে নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল দেখিয়ে বেশি ঘুষের টাকার বিনিময়ে মর্জিনা নামের অন্য এক জনকে পাস দেখায় নিয়োগ বোর্ড। চাকরি না পেয়ে সন্ধ্যার পর অসুস্থ হয়ে পরে লাবলী। পরে স্বজনরা তাকে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। তবে ঘুষের টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
স্থানীয় সূত্র ও অভিযোগে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নে শেখ শহিদুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান ঘটমাঝি ইউনিয়নের পূর্ব চিড়াইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোঃ লুৎফর মুন্সীর মেয়ে লাবলী আক্তারকে ২০১৮ সালে স্কুলে আয়া পদে চাকুরি দেওয়ার কথা বলে ৫ লাখ টাকা নেন। পরিবারটি ভিটামাটি বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা দেন প্রধান শিক্ষককে। টাকা দেওয়ার পর থেকে দীর্ঘ প্রায় ৪ বছর ধরে লাবনী আক্তার বিনা বেতনে বিদ্যালয়টিতে আয়া পদে কাজ করে আসছিলেন। গত ২৪ জুন ডিজির প্রতিনিধি মাদারীপুর ডনোভান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা মন্ত্রালয়ের প্রতিনিধি মাদারীপুর সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের উপস্থিতে ওই বিদ্যালয়ে একজন অফিস সহকারী, একজন পরিচ্ছন্নকর্মী, একজন নাইটগার্ড ও একজন আয়া পদে লিখিত ও মৌখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার আগেই আয়া পদের ঘুষের আলোচনা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। নিয়োগ পরীক্ষায় আয়া পদে ঝাউদি ইউনিয়নের বাসিন্দা নিজাম শিকদারের মেয়ে মর্জিনা আক্তার বেশি নম্বর পাওয়ায় তাকে নিয়োগ প্রদানের জন্য সুপারিশ করে নিয়োগ বোর্ড। তবে বেশি টাকা ঘুষের বিনিময়ে লাবনীকে ফেল দেখিয়ে মর্জিনাকে পাস দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী পরিবারের। এ নিয়ে অন্যান্য চাকরি প্রত্যাশীসহ স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
লাবলী আক্তার বলেন, ‘দীর্ঘ ছয় বছর আগে তার বাবা লুৎফর মুন্সী স্টোক করে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পরেন। পরে সংসার চালানোর মতো আর কেউ ছিলো না। পরে বাবার সংসারের হাল ধরি আমি। এদিকে মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসারে জোগান দেন। চার বছর আগে আমাকে স্কুলে আয়া পদে চাকরির দেওয়ার কথা বলে আমার কাছে ৫ লাখ টাকা চায় প্রধান শিক্ষক মো: লুৎফর মুন্সি। আমি ঋণ করে, জমিজমা ও ভিটামাটি বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা লুৎফর রহমান স্যারকে দেই। গত ৪ বছর ধরে বিনা বেতনে আমি ওই বিদ্যালয়ে আয়ার কাজ করে আসছি। আমাকে চাকরি দেয়ার কথা বলে হেড স্যার আমার প্রতিবন্ধী বাবাকে দিয়েও নাইট গার্ডের কাজ করিয়েছে। আমরা চার বোন আমাদের কোন ভাই নাই। আমরা নিজেরাই অনেক কষ্ট করে সংসার চালাই। আমি সরকার এবং প্রশাসনের কাছে আমার চাকরি ফেরত চাই এবং এই ঘটনার বিচার চাই।
লাবলী আক্তারের মা রেবেকা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েকে স্কুলের আয়া পদে নিয়োগের আশ্বাস দেওয়ার পর আমার মেয়ে সবকিছু ছেড়ে বিদ্যালয় নিয়েই পড়ে ছিল। চাকরি পাওয়ার জন্য বিনা বেতনে আয়ার দায়িত্ব পালন করেছে। এভাবে প্রায় ৪ বছর কেটে গেছে। এই ৪ বছর আমি অনেক ঋণ হয়ে গেছি। এদিকে ঘরে প্রতিবন্ধী স্বামী; চিকিৎসার টাকা জোগার করতে না পেরে এখন তিনি প্রতিবন্ধী হয়েছে। স্বামী সন্তান নিয়ে আমি মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমার মেয়ের চাকরিটা হলে হয়তো সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম।’
লাভলী আক্তারের প্রতিবন্ধী বাবা লুৎফর মুন্সী বলেন, আমার মেয়েকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে হেড মাস্টার লুৎফর রহমান। আমাকে বলছে তোমার মেয়েকে চাকরি দিব তুমি স্কুলে নাইটগার্ডের কাজ করো। আমি আমার মেয়ের চাকরির জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে সারারাত স্কুল পাহারা দিছি। আজকে অন্যের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে আমার মেয়েকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছে। আমি হেডমাস্টারের বিচার চাই।’
প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান বলেন, ‘ওই মেয়ে পরীক্ষায় পাস না করায় তাকে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। সে দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে এ বিষয় সত্য। তবে আমার বিরুদ্ধে ঘুষের টাকা লেনদেনের যে অভিযোগ দিয়েছে এটা মিথ্যা। লাবলীর কাছ থেকে আমি কোন টাকা নেইনি।’
শেখ শহিদুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি মোঃ ইলিয়াস হোসাইন হাওলাদার বলেন, ‘বৈধভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। পরীক্ষায় সবাই উপস্থিত ছিলো। নিয়োগ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হেড মাস্টার যদি কোন প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে আর সেই প্রার্থী যদি অভিযোগ করে তাহলে তদন্ত করে প্রমানিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মাদারীপুর সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ মোফাজ্জল হোসেন বলেন, নিয়োগ পরীক্ষায় যদি কোন অনিয়ম হয় তাহলে অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মাদারীপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ হাবিবউল্লাহ খান বলেন, ‘চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া অপরাধ। প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’