স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও মাদারীপুরে চূড়ান্ত হয়নি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা

সুুবল বিশ্বাস :
মাদারীপুরে ১৫ গণকবর সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। পাশাপাশি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও চূড়ান্ত হয়নি জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। শূণ্য পড়ে রয়েছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণের কার্যকর কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ভাবে ২০১৩ সালে মাদারীপুরের ১০টি বদ্ধভূমি উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য কর্মসূচির অর্ন্তভুক্ত করা হয়। মাদারীপুর গণপূর্ত বিভাগ সমীক্ষা শেষে ২০১৪ সালে মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করে। মন্ত্রনালয় ১০টির মধ্যে ৪টি বদ্ধভূমির উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের অনুমোদন দেয়। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও নানা জটিলতার কারণে গণপূর্ত বিভাগ সেগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারেনি। এদিকে প্রায় ১৫ বছর আগে মাদারীপুর শকুনী লেকের পাড়ে স্বাধীনতা অঙ্গনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নাম স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে শকুনী লেক সৌন্দর্যবর্ধনের সময় স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে জেলা প্রশাসকের আঙিনার পশ্চিম পাশে নতুন করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে স্মৃতিস্তম্ভে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সম্বলিত শিলালিপি আজও লাগানো হয়নি। যে কারণে বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানের সময় নামহীন স্মৃতিস্তম্ভে কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। এ বিষয়টি নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান, মুক্তিযোদ্ধা, এলাকাবাসী ও শহীদ পরিবারের স্বজনদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলায় ৭টি এবং রাজৈর উপজেলায় ৮টি গণকবর বা বদ্ধভূমি রয়েছে। এর মধ্যে (০১) সদর উপজেলার কুকরাইল মৌজার এ.আর হাওলাদার জুট মিলের অভ্যন্তরে জেলার বৃহৎ বধ্যভূমি। এখানে প্রায় ৭শত মুক্তি পাগল নর-নারী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। বর্তমানে স্থানটি গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। মিলের ডি-টাইপ বিল্ডিং-এর টর্চার সেলে অসংখ্য নারীকে মাসের পর মাস আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহীদ সুফিয়ার পরিবার অন্যতম। এ ছাড়া সহস্রাধিক মুক্তিপাগল বাঙালিকে মিলের উত্তর পাশে আড়িয়ালখাঁ নদের পাড়ে জুট মিলের জেটির ওপর দাঁড় করে ব্রাশ ফায়ার করে নদে ফেলে দেয়া হয়। এদের অধিকাংশ মানুষ ছিলো পূর্ব মাদারীপুর (শরীয়তপুর)-এর বিভিন্ন অঞ্চলের। (০২) সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের পূর্ব কলাগাছিয়া সুষেন হালদারের বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। (০৩) সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের তারাপদ শিকারীর বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। (০৪) সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর শিকদার বাড়ি বধ্যভূমি। বর্তমানে এই বধ্যভূমির উপরে গড়ে উঠেছে দ্বিতল ভবন, রয়েছে ব্যাংক ও অন্যান্য অফিস। এখানে স্মৃতি ফলক নির্মাণের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। (০৫) সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর গোপী ঠাকুরের বাড়ির পেছনে পুকুরের উত্তর পাশে বধ্যভূমি। বর্তমানে সেখানে বাঁশঝাড় ও মরিচ-বেগুনের চাষ করা হচ্ছে। (০৬) সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের চৌহদ্দি হাটখোলা বধ্যভূমি। (০৭) সদর উপজেলার পৌরসভার অধীন কুলপদ্বী সাবেক সরকারি শিশু সদন ভবনের পূর্ব পাশে বধ্যভূমি, যেখানে দোলযাত্রার ভাঙ্গা মঠ রয়েছে। বর্তমানে এর চারপাশ বেদখল হয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে মানুষের ঘরবাড়ি।
রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের (০৮) কমলাপুর গ্রামের কেষ্ট বৈদ্য’র বাড়ির পুকুর পাড় বদ্ধভূমি। (০৯) রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের পাখুল্লা গ্রামের রাসু গাটিয়ার বাড়ির পুকুর পাড় বধ্যভূমি। (১০) রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের গণেশ পাগলের সেবা আশ্রমের পূর্ব পাশে (যেখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়) পুকুর পাড় বধ্যভূমি। (১১) রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের আলেক ফকিরের বাঁশঝাড় (বুড়ির ভিটা) সংলগ্ন ৩ খালের সংযোগ স্থানে বধ্যভূমি। (১২) রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের সিদ্দিক মাতুব্বরের বাড়ির দক্ষিণ পূর্ব কোণে বধ্যভূমি। (১৩) রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের শচীন বারিকদারের বাড়ির দক্ষিন পাশে খালের পাড় (গনেশ বারিকদারের বাড়ির সামনে) বধ্যভূমি। (১৪) রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের ডা. রাসু বারিকদারের বাড়ির পাশে বাগানের ভেতরের খালপাড় দক্ষিন পূর্ব কোণে বধ্যভূমি। (১৫) রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের ছাতিয়ানবাড়ি গ্রামের পূর্ণ চন্দ্র বৈদ্য বাড়ির উত্তর পাড় পুকুরের মধ্যে বধ্যভূমি।
রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের সেনদিয়া, ছাতিয়ান বাড়ি, উল্লাবাড়ি ও পলিতা গ্রামের ৮টি বধ্যভূমিতে ১২৭ জন নর-নারী শহীদের লাশ রয়েছে। ১৯৭১ সালে (বাংলা ১৩৭৮ সালের ৫ জৈষ্ঠ্য) এই ৪টি গ্রামে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে। টেকেরহাটের এক চিহ্নিত রাজাকার মহিউদ্দিন হাওলাদার (মনি হাওলাদার) সহযোগিতায় পাক সেনা ও তাদের দোসররা ওই সব গ্রামের এবং আখ ক্ষেতে পালিয়ে থাকা নিরিহ নর-নারী-শিশুকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। পরে সন্ধার দিকে লাশগুলি ওইসব স্থানে মাটি চাপা দেয় গ্রামবাসি। ঘটনাকে স্মরণ করে স্থানীয় শহীদ পরিবারের সদস্যরা এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ২০০৯ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ ১৪১৬) সেনদিয়া গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন। সেদিন এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগন। স্মৃতিস্তম্ভে ১২৬ শহীদের নাম সম্বলিত একটি শিলালিপি লাগানো হয়েছে। সেদিন গণহত্যার সময় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অমূল্য কুন্ডুর ঘরে আগুন দিয়ে ঘরসহ তার বৃদ্ধা মাকে পুড়িয়ে হত্যা করে। বৃদ্ধার নাম না জানার কারণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে তার নাম খোঁদাই করা সম্ভব হয়নি।
মাদারীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম হারুণ-উর রশীদের কাছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “এখানে মুক্তিযোদ্ধাদেরও অবহেলা আছে, প্রশাসনেরও অবহেলা আছে। আমরা যখন ২০১৪-২০১৬ সালে সংসদের ক্ষমতায় ছিলাম, তখন থানায় থানায় গিয়ে যাচাই-বাছাই করেছিলাম। তালিকায় বার বার ভুল আসার কারণে চূড়ান্ত হয়নি। আগে ৮০জনের নাম ছিলো। পরে ৪৫জন এবং সর্বশেষ ৪৩জনের একটি তালিকা করে দিয়েছিলাম। বর্তমানে সম্ভবত মিনিস্ট্রিতে অথবা কল্যাণ ট্রাস্টে আছে।”
বদ্ধভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ব্যাপারে মাদারীপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: কামরুল ইসলাম খানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “২০১৪ সালে ১০টার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। মিনিস্ট্রি থেকে পাস হয়েছে ৪টা। এই ৪টার মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনোটারই কাজ শুরু করতে পারি নাই। তবে আশা করছি খুব শীঘ্রই কাজ শুরু করতে পারবো দুইটা। ডিসি অফিসে আমি জায়গা চেয়েছি। ডিসি অফিস থেকে গত সপ্তাহ দু‘য়েক আগে ডিসি মহোদয় জায়গা ভিজিট করেছেন। একটা কেন্দুয়ায়, একটা মিঠাপুরে। এই দুইটার উপরে এসিল্যান্ড খুব শীঘ্রই একটা প্রস্তব দিয়ে দিবে। এসিল্যান্ড প্রস্তাব দিলে আমরা মিনিস্ট্রিতে পাঠিয়ে কাজ শুরু করে দেবো। জুট মিলেরটাও লিষ্টে আছে। যেহেতু জায়গাটা নিষ্কন্টক না, সেহেতু ওখানে কাজ শুরু করতে পারছি না।”